মামলা জটের ধাক্কা আপীল বিভাগেও লেগেছে। বর্তমানে আপীল বিভাগে প্রায় ২২ হাজার মামলা বিচারাধীন। প্রত্যেক বিচারপতির জন্য গড়ে ৩ হাজার ৬শ’ ৬৬টির বেশি মামলা রয়েছে। এত মামলার বিপরীতে আপীল বিভাগে বিচারপতির সংখ্যা ৬ জন।
গত বৃহস্পতিবার বিচারপতি জিনাত আরা অবসরে গেছেন। অন্যদিকে হাইকোর্ট বিভাগের অবস্থা আরও খারাপ। হাইকোর্টে সাড়ে ৫ লাখ মামলার বিপরীতে বিচারপতি রয়েছেন মাত্র ৯৭ জন। সেখানে প্রত্যেক বিচারপতির ভাগে পড়ে ৫ হাজার ২২৩টি মামলা। উচ্চ আদালতসহ নিম্ন আদালতে মামলা বাড়লেও নিষ্পত্তির হারও আগের চেয়ে অনেকাংশে বেড়ে গেছে। গত বছর বিচারিক আদালতে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে।
বর্তমানে উচ্চ আদালতসহ নিম্ন আদালতে প্রায় ৩৬ লাখ মামলা বিচারাধীন রয়েছে। আইনজীবীদের অভিমত মামলাগুলোর শুনানি ও নিষ্পত্তি করার জন্য আরও দক্ষ ও অভিজ্ঞ বিচারক নিয়োগ করা দরকার।
আপীল বিভাগে এ সমস্ত মামলার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালেও মামলা রয়েছে। সেখানে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে ২৯ মামলা। পাহাড়সম মামলার কারণে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের রায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের আপীল নিষ্পত্তিতে ধীরগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। আপীল বিভাগে বিচারপতি নিয়োগ করা হলে এই সমস্যা অনেকাংশে কেটে যাবে বলে মনে করছেন আইনজীবীগণ।
সম্প্রতি আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এক প্রশ্নের জবাবে জাতীয় সংসদে বলেছেন, দেশের উচ্চ ও নিম্ন আদালতে ৩৫ লাখ ৮২ হাজার ৩৪৭ মামলা বিচারাধীন রয়েছে। আপীল বিভাগে ২১ হাজার ৮১৩টি বিচারাধীন মামলা রয়েছে। এর মধ্যে দেওয়ানি মামলা ১৪ হাজার ২৩টি, ফৌজদারি মামলা ৭ হাজার ৬৫৫টি এবং অন্যান্য মামলা ১৩৫টি। এছাড়াও হাইকোর্ট বিভাগে ৫ লাখ ৬ হাজার ৬৬৪টি মামলার মধ্যে দেওয়ানি মামলা ৯৬ হাজার ১১৪টি, ফৌজদারি মামলা ৩ লাখ ১৭ হাজার ৪৪৩ এবং অন্যান্য মামলা ৯৩ হাজার ১০৭টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। পাশাপাশি নিম্ন আদালতে ১৩ লাখ ২৮ হাজার ৬০০টি দেওয়ানি মামলা ও ১৭ লাখ ২৫ হাজার ২৭০টি ফৌজদারি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এ ছাড়া তিনি আরও বলেছিলেন, ২০০৯ সাল থেকে ২০১৮ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত সারাদেশের আদালতগুলোতে এক কোটি এক লাখ ৩৭ হাজার ৭৬১টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে।
বিচারাধীন মামলাসমূহ দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে বর্তমান সরকার বিভিন্নমুখী কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। বিচারকের সংখ্যা বৃদ্ধি, নতুন আদালত সৃষ্টি, আদালতের অবকাঠামো উন্নয়ন, বিচারকদের দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণ, মামলা নিষ্পত্তিতে তদারকি বৃদ্ধি করাসহ সরকারের গৃহীত পদক্ষেপে সাফল্য অর্জন এসেছে। আইন ও বিচার বিভাগ সারাদেশের বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতা কমিয়ে বিচার কাজ ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে বিচারকের সংখ্যা বৃদ্ধি ও এজলাস সঙ্কট নিরসনে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহম্মেদ বলেছেন, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি একান্ত প্রয়োজন। এতে করে তাড়াতাড়ি মামলা নিষ্পত্তি হবে। সমাজে শান্তি ফিরে আসবে। মামলা ফাইল হলে এটা মীমাংসা করা যায়। পক্ষদ্বয়ের মধ্যে আলাপ আলোচনা করে। ক্রিমিনাল মামলাও এডিআরের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা যায়। এই ব্যবস্থা না হলে বিচার ব্যবস্থায় ধস নামবে।
সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী স্বপন রায় বলেছেন, মামলাগুলোর শুনানি ও নিষ্পত্তি করার জন্য আরও দক্ষ ও অভিজ্ঞ বিচারক নিয়োগ করা দরকার। আদালতগুলোতে মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে। আরও বাড়লে ভাল হয়। এ ছাড়া আপীল ফাইলের পাশাপাশি জামিনের দরখাস্ত দেয়া হয়। অর্থাৎ একটি মামলার ভেতরে তিনটি মামলা থাকে। এর ফলে মামলার সংখ্যা বেড়ে যায়। তিনটি না করে একটি মামলা করলেই মামলার সংখ্যা কমে যাবে।
বেশ কয়েক বছর আগে আইন কমিশন মামলা জট কমাতে সুপারিশ দিয়েছিল। ঐ সুপারিশের মধ্যে ছিল, জরুরী ভিত্তিতে কয়েক ধাপে ৩ হাজার নতুন জজ নিয়োগ। প্রতি জেলা সদরে নতুন এজলাস কক্ষ নির্মাণ সহ ভৌত কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে সমগ্র বিচার ব্যবস্থাকে ডিজিলাইজেসন করা। সহকারী জজসহ প্রত্যেক বিচারকের জন্য একজন করে দক্ষ স্টেনোগ্রাফার নিয়োগ দিতে হবে। বিচারকদের নিজ হাতে সাক্ষীর জবানবন্দী রেকর্ড করার পরিবর্তে কম্পিউটার টাইপ চালু করা দরকার। একাধিক তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে, অধিকাংশ বিচারক সকাল সাড়ে নয়টা এজলাসে উঠেন না এবং অনেকে দ্বিতীয়ার্ধেও উঠেন না।
চাঞ্চল্যকর মামলা নিষ্পত্তি
২০১৯ সালে বিচার বিভাগ কর্তৃক বহুল আলোচিত মামলাসমূহ নিষ্পত্তি হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর পাবনার ইশ্বরদীতে বোমা হামলা মামলা, গুলশানের হোলি আর্টিজান হামলা মামলা, উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের ছাত্রী সুমাইয়া রিশা হত্যা মামলা, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত দিয়া খানম মিম ও আব্দুল করিম রাজীবের মামলা, গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের দুর্নীতির মামলা, গাইবান্ধার সংসদ সদস্য লিটন হত্যা মামলাসহ চাঞ্চল্যকর মামলাসমূহ দ্রুত নিষ্পত্তি করা হয়েছে।
এছাড়া, চাঞ্চল্যকর ফেনীর নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলায় ৯২ (বিরানব্বই) জন সাক্ষীর মধ্যে ৮৭ জন সাক্ষীকে পরীক্ষা করে মাত্র ৬২ কার্যদিবসে বিচার কার্যক্রম সমাপ্ত করা হয়। গত ২৪/১০/২০১৯ খ্রিঃ তারিখ ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল এ মামলার ১৬ জন আসামিকে মৃত্যুদ- প্রদান করে এবং প্রত্যেককে ১ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করে এবং অর্থদণ্ডের আদায়কৃত অর্থ ভিকটিম নুসরাত জাহান রাফির পিতা-মাতাকে প্রদানের নির্দেশ প্রদান করা হয়। সূত্র- জনকণ্ঠ