1585325780.jpeg

চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম ও আইনি অধিকার প্রসঙ্গ

নিরাপদ কর্মক্ষেত্রের অধিকার দাতব্য নয় বরং এটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে আইনত সুরক্ষিত সকলের জন্য একটি অবিচ্ছেদ্য অধিকার।

সম্প্রতি বাংলাদেশে কোভিড -১৯ বিস্তারে কর্মক্ষেত্রে পেশাগত স্বাস্থ্য এবং নিরাপদ কমস্থলের অধিকার বিষয়টি আবার আলোচনায় এসেছে। করোনা ভাইরাস বিস্তার সময়কালীন দেশের সরকারী কিংবা বেসরকারী হাসপাতালগুলো নির্বিশেষে তাঁদের প্রতিষ্ঠানের চিকিত্সকদের ন্যূনতম ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই) সরবরাহ চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে এবং সাধারণ জনগন এতে আতঙ্কিত ও ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। এই ঘটনাটি কেবলমাত্র চিকিৎসকদের সামগ্রিক পেশাগত সুরক্ষাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেনি, একই সাথে দেশের সামগ্রিক জনস্বাস্থ্য-ব্যবস্থা সমগ্র দেশের সাধারণ জনগণের কাছে মারাত্মকভাবে হতাশার প্রতীক হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং মূলধারার গণমাধ্যমে এটি যথাযথ ও বৈধভাবে সমালোচিত হয়েছে।

কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা একটি সম্মিলিত ক্ষেত্র, এটি এমন কোনও প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার সমস্ত বিভাগকে নিয়ে গঠিত যা প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষভাবে সংস্থার সাথে জড়িত সকলের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাস্থ্য, সুরক্ষা এবং সুস্বাস্থ্যের জন্য কাজ করে। একটি প্রতিষ্ঠানের সবগুলো বিভাগের অভ্যন্তরীণ সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফল হচ্ছে ‘কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা’। এখানে কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা কেবলমাত্র কোন রোগকে বোঝায় না বরং এটি প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক স্বাস্থ্যকে বোঝায়, যেমন কর্মীদের শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক স্বাস্থ্য। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (ডব্লিউএইচও) অনুসারে পেশাগত স্বাস্থ্য ও সুরক্ষার মূল কাজ হল কর্মক্ষেত্রে যে কোনও ধরণের ঝুঁকি বা সম্ভাব্য বিপদ প্রতিরোধ করা যাতে করে প্রতিষ্ঠানটি তার উদ্দেশ্য সুন্দরভাবে বাস্তবায়ন করতে পারে।

তবে কর্মক্ষেত্রে চিকিৎসকদের জন্য ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই) সম্পর্কে মেডিকেল অনুশীলন এবং বেসরকারী ক্লিনিকস এবং ল্যাবরেটরিজ (নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশ ১৯৮২এ; মেডিকেল নেগলিজেন্স আইন ১৮৬০; ‘মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল অ্যাক্ট ১৯৮০’ এর কোনও বিধান স্পষ্টভাবে কথা বলে না। সুতরাং আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে চিকিৎসক বা হাসপাতালের কর্মচারীদের ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষামূলক সরঞ্জাম (পিপিই) প্রদান সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের একটি দাতব্য বা অনুগ্রহ এবং এর কোনও আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই। তবে বাস্তবিকভাবে চিত্রটা উল্টো এবং এর আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কেননা ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামাদি (পিপিই) সম্পর্কিত অধিকারগুলি বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর ৫ম অধ্যায়ে যথাযথভাবে স্বীকৃত। এই আইনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি নিরাপদ এবং স্বাস্থ্যকর কর্মক্ষেত্র নিশ্চিত করা যাতে প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা কার্যকরভাবে তার উদ্দেশ্যের উৎকর্ষ সাধন করতে পারে।

এই আইনের ধারা ৭৮ উপধারা (১) মতে “…কর্তৃপক্ষ শ্রমিকগণের ব্যক্তিগত সুরক্ষা যন্ত্রপাতি সরবরাহ ও ব্যবহার নিশ্চিত করা ব্যতীত কাউকে কর্মে নিয়োগ করিতে পারিবে না এবং এই বিষয়ে মালিক কর্তৃক নির্ধারিত পন্থায় একটি রেকর্ড বুক সংরক্ষণ করিতে হইবে”. এখন যদি সতর্কতার সাথে আইনটির ব্যাখ্যা করা হয় তবে আমরা দেখতে পাব যে আইনে ব্যক্তিগত সুরক্ষা যন্ত্রপাতি সরবরাহ ও ব্যবহার নিশ্চিত করা ব্যতিত কোন কর্মচারী নিয়োগেই নিষেধাজ্ঞা রয়েছে এবং সাথে সাথে এটিও দেখতে পাবো যে আইনে ‘করিতে হইবে’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। যা ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম বজায় রাখার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের একটি ভারী বাধ্যবাধকতা দেয়। অতএব, কর্মচারীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম নিশ্চিত করা কোন প্রতিষ্ঠানের কাজ পরিচালনা করার ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক। এছাড়া টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ৮.৮ নং লক্ষ্য এবং ১২ নং লক্ষ্য উভয়ই পুরুষ বা মহিলা এবং সরকারী বা প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান নির্বিশেষে কর্মচারীদের কর্মক্ষেত্রে নিরাপদ এবং সুরক্ষিত পরিবেশের অধিকার রক্ষা করে এবং তা প্রচার করে। কাজেই কর্মক্ষেত্রে ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম নিশ্চিত করা একটি অপরিহার্য আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধতা। কিন্তু আমরা প্রত্যক্ষ করলাম স্বাস্থ্য খাতে এখন পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। তার কারণ বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো এটি বেশিরভাগ সরকারী সংস্থা বা কিছু ধরণের অলাভজনক প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি কিছু প্রতিষ্ঠানের জন্য সম্পূর্ণরুপে প্রযোজ্য নয়। এই আইনের আওতার বাইরে বহু সংখ্যক সামাজিক ভাবে গুরত্বপূর্ণ কর্মক্ষেত্র ছেড়ে দেয়া হয়েছে এর মধ্যে হাসপাতাল অন্যতম। সুতরাং সংসদকে অবশ্যই অবিলম্বে প্রভাব নিয়ে বিভ্রান্তি দূর উচিত  সাথে সাথে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া উচিত।

যদিও প্রায়শই এটি বলা হয়ে থাকে যে বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬এর বেশিরভাগ অংশই আন্তর্জাতিক মানের এবং এর একটি শক্তিশালী কার্যপরিধিও বিধ্যমান, তবে বাংলাদেশে এটি সঠিক ভাবে কার্যকরভাবে না হওয়ায় শ্রমিক এবং কর্মচারীরা মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। বিদ্যমান শ্রম আইনের যথেচ্ছ প্রয়োগের অভাবে অতীতে আমরা দেখেছি যে বাংলাদেশে হাজার হাজার শ্রমিক দুর্ঘটনার কর্মস্থলে শিকার হয়ে মারা যায় বা আহত হয়। তবে এটি প্রমাণিত যে দেশের আইনি কাঠামো যেকোন শ্রমিক বা কর্মচারী অর্থাৎ সরকারী বা বেসরকারী সংস্থার কর্মচারী, এনজিও কর্মী এবং শেষ পর্যন্ত দেশের স্বাস্থ্যের মেরুদণ্ড এই ডাক্তারদের প্রয়োজনীয় ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষামূলক সরঞ্জামগুলি (পিপিই) প্রদানে আইনগত ভাবে প্রাতিষ্ঠানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে যদিও এর প্রয়োগ প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। তবুও, সরকারী বা বেসরকারী যে কোনও প্রতিষ্ঠানের নিয়মকানুন এবং পদ্ধতি তৈরি করার সময় কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই শ্রম আইন ২০০৬ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বিধি সাপেক্ষে ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামের (পিপিই) মানকে স্বীকৃতি দিতে হবে এবং সে গুলো নিশ্চিত করতে হবে।

এটি সত্য যে ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষামূলক সরঞ্জামগুলি (পিপিই) ছাড়া চিকিৎসকরা বা হাসপাতালের কর্মচারীরা কোন সম্ভাব্য কোভিড -১৯ রোগীকে পরিচর্যা করতে দ্বিধাগ্রস্থ হবেন কারণ এটি বাস্তবিক যে তাদের নিজস্ব পারিবারিক জীবনও রয়েছে বা কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের পরিবারগুলো তাদের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু নৈতিক বাধ্যবাধকতা ঊপেক্ষা করেও আইনী বাধ্যবাধকতা থাকা সত্ত্বেও, যখন দেশের কোন নামী হাসপাতাল দেশের জরুরি পরিস্থিতিতে, তার কর্মচারীদের একটি প্রেস রিলিজের মাধ্যমে, জনসাধারণের সেবার প্রদানের নিমিত্তে নিজস্ব দায়বদ্ধতা থেকে ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষামূলক সরঞ্জামগুলি (পিপিই) সংগ্রহ করার নির্দেশ দেয়, তখন প্রশ্ন জাগে তারা কি সত্যিই জনস্বাস্থ্য নিশ্চিত করছে? না কি বাধাগ্রস্থ করছে? তবে এর আগে আরও একটি বড় প্রশ্ন থেকে যায় যে, এই সামগ্রিক অব্যবস্থাপনা এবং যথাসময়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের অভাবের বড় ব্যর্থতার দায়ভার কে বহন করবে?

লেখক- আইন বিভাগের শিক্ষার্থী।