1591981198.jpg

‘শাস্তির পরিমাণ ও প্রতিক্ষিত নীতিমালা’- প্রসঙ্গে কিছু কথা

‘শাস্তির পরিমাণ ও প্রতিক্ষিত নীতিমালা’ শিরোনামের লেখায় বিদ্যমান ফৌজদারি আইনে একই অপরাধের ভিন্ন শাস্তির ক্ষেত্রে দোষীকে শাস্তি আরোপে বিচারকের সেচ্চাধীন ক্ষমতার কথা উল্লেখ করে sentencing hearing ­­এর ব্যবস্থা না থাকায় শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে কোন Scenting Policyএর অনুপস্থিতিতে একই ধরণের অপরাধে একেক আদালত একেক শাস্তি প্রয়োগের সুযোগ হেতু কোন Uniformity থাকছে না মর্মে উল্লেখ করা হয়। Uniformed, Justified and Proportionate শাস্তি আরোপ ও শাস্তির যথাযোগ্য প্রয়োগের জন্য একটা পূর্ণাঙ্গ Sentencing Policy বা গাইড লাইন হিসেবে সরকার কর্তূক আইন বা বিধি বা নীতিমালা বা সুপ্রীম কোর্ট কর্তৃক কোন রায়ে বা সার্কুলার ইস্যু করার পক্ষে মতামত ব্যক্ত করা হয়। উক্ত শিরোনামে শাস্তি প্রয়োগে সুনির্দিষ্ট Statutory principle নেই মর্মে উল্লেখ করে উচ্চাদালতের বিভিন্ন নজীরে ব্যবহৃত Mitigating Factors and Aggregating Factors এর কথা বিবেচনা নিয়ে নজীরের উল্লেখ করে যৌক্তিক শাস্তি আরোপে কামনা করা হয়।

আমার সরল চিন্তায় প্রশ্ন জাগে, ফৌজাদারি বিচার নিষ্পত্তিতে শাস্তি আরোপের ক্ষেত্রে কোন সুনির্দিষ্ট বিধান বা কোন Sentencing Policy কিংবা এতদ্ববিষয়ে কোন আইন বা বিধি বা নীতিমালা বা মহামান্য সুপ্রীম কোর্টের সার্ক্যুলার কি আসলেই প্রয়োজন আছে?

মূল আলাচনায় আাসা যাক। বিচারিক আদালতের সেচ্চাধীন ক্ষমতার আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে সাক্ষ্য গ্রহণ, গৃহীত সাক্ষ্য বিচার বিশ্লেষণ, উক্ত বিশ্লেষণে ঘটনার অস্তিত্বের অনুমান এবং সর্বোপরি দোষি ব্যক্তিকে শাস্তি আরোপে একচ্ছত্র ক্ষমতার প্রয়োগকেই বুঝায়। তবে অত্র আলোচনায় প্রমাণিত ঘটনার উপর দোষীকে শাস্তি আরোপে সেচ্চাধীন ক্ষমতা আরোপের বিষয়টি খুবই প্রাসঙ্গিক হলেও গৃহীত সাক্ষ্য প্রমাণে বিচারিক বিশ্লেষণ সংক্রান্তে আইনি অবস্থান সঙ্গত কারণেই আলোচনার এই বিষয়বস্তু হবে। কেননা শাস্তি আরোপের পরিমাণ কেস টু কেস ভেরি করে যা গৃহীত সাক্ষ্যের বিচারিক পর্যালোচনার উপর নির্ভর করে।

গৃহীত সাক্ষ্য প্রমাণে বিচারিক আদালতের সেচ্চাধীন ক্ষমতা প্রয়োগের বিষয়ে দেওয়ানী বিচার ব্যবস্থায় সুনির্দিষ্ট আইনি (সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ২২ ধারা) বিধান থাকলেও ফৌজাদারি বিচার ব্যবস্থায় বিভিন্ন আইনি পর্যায়ে উক্ত ক্ষমতার উপাদানসমূহবিদ্যমান আছে। যেমন –  সাংবিধানিক বিধি বিধানের আলোকে ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার মৌলিক আইন হচ্ছে ১৮৯৮ সনের ফৌজদারি কার্যবিধি ও ১৮৭২ সনের সাক্ষ্য আইন এবং উভয় আইনে সাক্ষ্য গ্রহণ পদ্ধতি ও সাক্ষ্যের প্রাসঙ্গিকতা, অনুমানের নীতি সমূহ বিধৃত আছে।

বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদ এবং ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৫৩,৩৫৬ ও ৩৬৬ ধারায় পাবলিক ট্রায়ালে পক্ষদ্বয়ের শারিরীক অংশগ্রহণ বিষয়ে বিধি বিধান করেছে যা বিচার কালে উপস্থাপিত সাক্ষ্য প্রমাণ শারিরীক রেকর্ডের উপর একটি পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ দিয়েছে। বিচারিক আদালত ফৌজদারি কার্যবিধির ২৪৪ বা ২৬৫ জি ধারার বিধি বিধানঅনুসরণে সাক্ষ্য গ্রহণের পর ২৪৫ বা ২৬৫কে ধারা অনুসারে রায় প্রচারের মাধ্যমে শাস্তি আরোপের ক্ষেত্রে আদালতের বিবেচনাকেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে অর্থাৎ গৃহীত সাক্ষ্য প্রমাণ ও যুক্তিতর্ক শ্রবণের পর (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে) শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে বিচারিক আদালত তার বিবেচনা প্রয়োগ করবেন মর্মে বিধান আছে। এখানে বিচারিক আদালতের বিবেচনা প্রয়োগের ক্ষেত্রে কোন গাইডলাইন বা উচ্চাদাতের কোন নির্দেশনা বা কোন প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের নীতি বা সার্ক্যুলার প্রচারের স্পেস রাখা হয় নাই।

অন্যদিকে গৃহীত সাক্ষ্য বিচারিক বিশ্লেষণের জন্য সাক্ষ্য আইন বিচারিক আদালত কে May Presume, Shall Presume and Conclusive Proof (৩ ধারা) এবং “Evidence may be given of fact in issue and relevant facts (৫ ধারা) সংক্রান্তে যে ক্ষমতা দিয়েছে তাতে সেচ্চাধীন ক্ষমতার উপাদানসমূহ নিহিত আছে। এই সকল বিধানের মাধ্যমে বিচারিক আদালত গৃহীত সাক্ষ্য প্রমাণ বিশ্লেষণে কোন ঘটনার existence or non existence of facts to be relevant অনুমান করে নিতে পারেন।

আবার এই আইনের ২৪ থেকে ৩০ ধারায়স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি কখন ও কতটুকু প্রাসঙ্গিক হবে তা নির্ধারণের শর্ত ও ক্ষেত্রসমূহ বর্ণনা করে বিচারিক আদালতের সেচ্চাধীন ক্ষমতাকে সুনির্দিষ্ট করেছে। এই আইনের ৮০ ধারায় বর্ণিত শর্ত সমূহ পূর্ণ হলে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিকে জেনুইন হিসেবে অনুমান করার ক্ষমতাও দিয়েছে। ১১৪ ধারার ক্ষমতাবলে বিচারিক আদালত “upon regard to its relation of common course of natural events, human conduct and public and private business” কিছু ঘটনার অস্তিত্ব অনুমান করতে পারে। এ আইনের ৫ থেকে ১৬ ধারা ও ১৫৬ ধারায় circumstantial facts to be given in evidence দেয়া যাবে মর্মে বিধান আছে এবং শর্ত পূরণ সাপেক্ষে এই সাক্ষ্যের অস্তিত্বের অনুমান করা যাবে মর্মে বিধান আছে যা বিচারিক আদালতের সেচ্চাধীন ক্ষমতাকে সুনির্দিষ্ট করেছে।

সুতরাং এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ফৌজদারি কার্যবিধি ও সাক্ষ্য আইন বিচারিক আদালত কে গৃহীত সাক্ষ্য বিশ্লেষণ সংক্রান্তে যে ক্ষমতা দিয়েছে তা শাস্তি আরোপের ক্ষমতা গাইড করে এবং বিচারিক আদালত প্রমাণিত সাক্ষ্যের সাথে অভিযুক্তের দোষ ঘোষণা করে প্রমাণিত সাক্ষ্যে তার অংশগ্রহণের বিষয়টি নিয়েও শাস্তি আপোপের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

তবে শিরোনামে বক্তব্য কে যদি সত্য ধরে নিই; তাহলে কিছু মৌলিক বিষয় উত্থাপিত হয় যার আইনি বিশ্লেষণ প্রয়োজন –

প্রথমত : শাস্তি আরোপের ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধিতে (২৪৫ ধারা, ২৬৫কে ধারা) গৃহীত সাক্ষ্য প্রমাণ বিচার বিশ্লেষণের ক্ষমতা  বিচারিক আদালতের বিবেচনাতেই রাখা হয়েছে। এমতাবস্থায় ফৌজদারি কার্যবিধি ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার পদ্ধতিগত মৌলিক আইন হওয়ায় ‘বিচারিক আদালতের বিবেচনা’ বিষয়ে অন্য কোন নতুন আইন বা বিধি বা নীতিমালা বা মহামান্য সুপ্রীম কোর্টের সার্ক্যুলার তৈরি করলে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে পদ্ধতিগত মৌলিক আইন কে খর্ব করবে প্রকারান্তরে সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদে গৃহীত নীতিকে খর্ব করবে।

দ্বিতীয়ত : শাস্তি আরোপের ক্ষেত্রে ‘বিচারিক আদালতের বিবেচনা’ প্রকারান্তরে বিচারিক আদালতের সেচ্চাধীন ক্ষমতা যেখানে পদ্ধতিগত মৌলিক আইন দ্বারাই সুনির্দিষ্ট সেখানে নতুন কোন বিধি না নীতিমালা বা সার্ক্যুলার নতুনভাবে অস্পষ্টতা তৈরি করবে।

তৃতীয়ত : সাংবিধানিক বিধানের Delegated Legislation নীতি অনুসারে যেখানে মূল আইন দ্বারা ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়ে নিয়ম বা বিধিমালা তৈরি করার বিধান আছে সেখানে সেচ্চাধীন ক্ষমতা বিষয়ে যেহেতু কোন মূল আইন নেই তাই নীতিমালা বা বিধি মালা তৈরি আইনি সুযোগ থাকবে না।

চতুর্থত : যুক্তির খাতিরে যদি মূল আইন ফৌজাদারি কার্যবিধি কে ধরা হয় তাহলে এই আইনের ২৪৫ ধারা বা ২৬৫কে ধারা Delegated Legislation বিষয়ে ক্ষমতা প্রদান না করায়শাস্তি আরোপের ক্ষেত্রে বিচারিক আদালতের সেচ্চাধীন ক্ষমতা বিষয়ে নীতিমালা বা বিধিমালা তৈরি করা আইন বিরুদ্ধ হবে।

পঞ্চমত : শাস্তি আরোপের ক্ষেত্রে বিচারিক আদালতের সেচ্চাধীন ক্ষমতা বিষয়ে নীতিমালা বা বিধিমালা তৈরির নামেরাষ্ট্রের প্রশাসন যন্ত্রের উপর নির্ভর করা কিংবা প্রশাসনিক বিবেচনা ও সন্তুষ্টির উপর ছেড়ে দেওয়া বিচার বিভাগের স্বাধীনতার হস্তক্ষেপের সামিল হবে।

ষষ্ঠত : সংবিধানের ১০৮ অনুচ্ছেদ এবং ১৯৭৩ সনের সুপ্রীম কোর্ট অব বাংলাদেশ (হাইকোর্ট ডিভিশন) রুলসও১৯৮৮ সনের সুপ্রীম কোর্ট অব বাংলাদেশ (আপীল ডিভিশন) রুলস অনুসারেউভয় বিভাগ ও অধ:স্তন আদালতের উপর শুধুমাত্র প্রশাসনিক কার্যক্রম বিষয়ে প্রশাসনিক আদেশ করার ক্ষমতা আছে।তাহলে মহামান্য সুপ্রীম কোট প্রশাসনিক আদেশ বা সার্কুলারের মাধ্যমে শাস্তি আরোপের ক্ষেত্রে বিচারিক আদালতের সেচ্চাধীন ক্ষমতা প্রয়োগ করার বিষয়টি আলোচনার দাবি রাখে।

সপ্তমত : একেক মামলার Facts and Circumstances ভিন্ন ভিন্ন হওয়ায় বিচারিক পর্যালোচনাও বিচারিক সিদ্ধান্ত ভিন্ন হওয়ায়ই স্বাভাবিক। মহামান্য উচ্চাদালতও সংশ্লিষ্ট মামলার বিষয়ে গাইডলাইন দিয়ে থাকেন। কিন্তু ভিন্ন Facts and Circumstances এ ভিন্ন পর্যালোচনায়ভিন্ন বিচারিক সিদ্ধান্তে কমন গাইডলাইন দেওয়া যাবে কিনা তা আলোচনার দাবি রাখে। তবে  case to case ভেদে time to time Guideline মনে হয় কার্যকারী হতে পারে।

যদি শাস্তি আরোপের বিষয়ে কোন আইন বা নীতিমালা বা বিধিমালা বা সার্ক্যুলারমূলে Sentencing Policy বা গাইডলাইন তৈরি করাহয় তাহলে বিচারিক আদালতের জন্য বড় একটি Challenge হবে যা বিচারিক সংস্কৃতিকে আঘাত হানার আশংকা থাকবে। কেননা সাক্ষ্য প্রমাণ এড়িয়ে গাইডলাইনের উপর নির্ভরতার প্রবণতা এবং গাইডলাইনের সাথে না গেলেই বিচারিক প্রাজ্ঞতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা বিচারিক স্বাধীনতা কে খর্ব করার আশংকা দেখা দিবে। আর ডিফেন্স পক্ষও আপীল বা রিভিশনে গাইডলাইন মানা হয় নাই বা আইনের ব্যত্যয় হয়েছে এই অজুহাতে বিচার ব্যবস্থায় প্রত্যেক্ষ বাধা প্রদানের সুযোগ পাবেযা বিচারিক স্বাধীনতায় আঘাত হানতে পারে।

পরিশেষে একটি অন্যরকম বিষয়ের অবতারণা করে বিষয়েক্তা শিরোনামটি রচিত হয়েছে। তার যুক্তিখন্ডন সত্যিই শুধু কঠিন কাজ। তবে একজন সিনিয়র অফিসারের মতামত কে সরল বিশ্বাসে অগোছালো যুক্ত দিয়ে খন্ডন করার চেষ্টা করায় অনিচ্ছাকৃত ভূলের জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।

লেখক: সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, কক্সবাজার।