1571672596.jpg

ট্রাইব্যুনাল না হওয়া পর্যন্ত মাদক মামলার বিচার আগের নিয়মে

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলার বিচারকাজ নিম্ন আদালতে আগের মতোই চলবে বলে রায় দিয়েছে হাইকোর্ট। ফলে তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ এ মাদক মামলার বিচারের পথ খুলল।

বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ রোববার (২০ অক্টোবর) এ রায় দেয়।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের পর সরকার সেই আইন অনুযায়ী ট্রাইব্যুনাল স্থাপন না করায় হাইকোর্টের এক আদেশের পর বিচারে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছিল।

রায়ে দেওয়ার সঙ্গে মাদকদ্রব্য অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল স্থাপন ও জেলা জজ বা দায়রা জজকে দায়িত্ব দিয়ে সরকারের গেজেট না করাকে অনভিপ্রেত, দুঃখ ও হাতাশাজনক উল্লেখ করেছে হাইকোর্ট।

এদিকে রাজধানীর বংশাল থানায় করা যে মাদক মামলা নিয়ে হাইকোর্টের আগের আদেশটি এসেছিল, তার আসামি মো. মাসুদুল হক মাসুদের জামিন প্রশ্নে জারি করা রুল যথাযথ ঘোষণা করে বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাকে জামিন দেওয়া হয়েছে।

তবে জামিনের অপব্যবহার করলে তা বাতিল হয়ে যাবে।

আদালতে আসামিপক্ষে আইনজীবী ছিলেন আল ফয়সাল সিদ্দিকী। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারওয়ার হোসেন বাপ্পী।

১৯৯০ সালে করা ‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন’ গত বছরের ডিসেম্বরে সংশোধন করা হয়।

সংশোধিত আইনের ৪৪(১) ধারায় বলা হয়েছে, এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, সরকার, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, প্রয়োজনীয়স সংখ্যক মাদকদ্রব্য অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করতে পারবে।

(৪) উপ-ধারায় বলা হয়েছে, এই ধারার অধীন ট্রাইব্যুনাল স্থাপিত না হওয়া পর্যন্ত, সরকার, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, সংশ্লিষ্ট জেলার যে কোনো অতিরিক্ত জেলা জজ বা দায়রা জজকে তার নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত ট্রাইব্যুনালের দায়িত্ব প্রদান করতে পারবে।

কিন্তু সরকার এ পর্যন্ত কোনো ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করেনি। অতিরিক্ত ট্রাইব্যুনালের দায়িত্বও দেওয়া হয়নি আদালতকে।

ফলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলার বিচারে কার‌্যত কোনো আদালত না থাকায় এ জটিলতার সৃষ্টি হয়।

ইয়াবা ও হেরোইনসহ গত বছর ২৭ ডিসেম্বর মাসুদুল হক মাসুদ নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ বিষয়ে বংশাল থানায় করা মামলায় গত ২২ জানুয়ারি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। এরপরই নিম্ন আদালতে জামিন চান আসামি। কিন্তু ওই আদালত জামিনের আবেদন খারিজ করে।

এই আদেশের বিরুদ্ধে জামিন চেয়ে হাই কোর্টে আবেদন করেন মাসুদ। ওই জামিন আবেদনের ওপর শুনানির সময় জামিনের নথি পর্যালোচনা করে হাই কোর্ট দেখতে পায়, ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত মাদক মামলাটি আমলে নিয়ে তা বিচারের জন্য ঢাকা মহানগর তৃতীয় যুগ্ম দায়রা জজ আদালতে পাঠায়।

যেহেতু সংশোধিত ‘মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন’র ৪৪(১) ধারা অনুযায়ী সরকার কোনো ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করেনি এবং (৪) উপধারা অনুযায়ী অতিরিক্ত জেলা জজ বা দায়রা জজকে দায়িত্বের অতিরিক্ত এ ট্রাইব্যুনালের দায়িত্ব দেয়নি, তাই আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে মামলাটি বিচারের জন্য তৃতীয় মহানগর দায়রা জজ আদালতে পাঠানো হয়েছে বলে উচ্চ আদালতকে জানান আসামির পক্ষের আইনজীবী আল ফয়সাল সিদ্দিকী।

এরপরই গত ৮ জুলাই হাই কোর্টের এই বেঞ্চ স্বরাষ্ট্র সচিব ও আইন সচিবকে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলে। এছাড়া হাই কোর্ট দুই বিচারককে কারণ দর্শাতে বলে।

হাইকোর্টের আদেশ অনুযায়ী, গত ২৫ জুলাই মামলাটি উচ্চ আদালতের ওই বেঞ্চে ওঠে। বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক ১৩ অক্টোবর তারিখ রেখে সেদিন বলেছিলেন, “আশা করছি ১৩ অক্টোবরের মধ্যে এ সংক্রান্ত গেজেট জারি হবে। আমরা সেই সুখবরের প্রত্যাশায় রইলাম।”

কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ থেকে কোনো অগ্রগতি জানাতে না পারায় আদালত আগের নিয়মেই মামলার বিচার করার রায় দেয়।

‘বিচারে স্থবিরতা থাকতে পারে না’
রায়ে বলা হয়েছে, “এটা বাস্তবতা যে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রন আইন ২০১৮ সালের ১০ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হলেও ওই আইনের বিধান অর্থাৎ ৪৪ ধারা অনুযায়ী মাদক সংক্রান্ত অপরাধের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল স্থাপিত না হওয়া পর্যন্ত সরকারি গেজেট দ্বারা অতিরিক্ত জেলা বা দায়রা জজকে নিজ দয়িত্বের অতিরিক্ত ট্রাইব্যুনালের দায়িত্ব আজ পর্যন্ত দেওয়া হয়নি।

“নিম্ন আদালতগুলোতে মাদক সংক্রান্ত মামলার জামিন ও বিচারকাজ স্থবির হয়ে পড়েছে এবং বিভিন্ন আইনি জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মামলার বিচারিক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে অছে। বিভিন্ন ফৌজদারি মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে আমাদের প্রতিনিয়ত এই সৃষ্ট অচলাবস্থা লক্ষ্য করতে হচ্ছে।”

রায়ে আরও বলা হয়েছে, “রূঢ় বাস্তবতা এটাই যে, মাদক নিয়ন্ত্রন আইনের ৪৪ ধারা অনুযায়ী কোনো ট্রাইব্যুনাল কিংবা বিকল্প হিসেবে গেজেটের মাধ্যমে অতিরিক্ত জেলা বা দায়রা জজকে ট্রাইব্যুনাল হিসেবে কাজ পরিচালনার পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি বা আইন সংশোধনও করা হয়নি। সৃষ্ট এ পরিস্থিতি অনভিপ্রেত, দুঃখ ও হতাশাজনক। আমরা দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, বিচার কার্যক্রমে কোনো স্থবিরতা বা শূন্যতা থাকতে পারে না।”

সামগ্রিক বিবেচনার কথা উল্লেখ করে রায়ে বলা হয়েছে, যেহেতু মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রন আইন ২০১৮’র ৪৪ ধারা এখনও কার্যকর হয়নি, তাই বিচার প্রক্রিয়া শূন্যতা পূরণে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫(২) ধারা এক্ষেত্রে প্রয়োগযোগ্য এবং কার্যকারিতা পাবে।

‘শিগগিরই হয়ে যাবে’
রায়ের পর রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, “আদালত এর আগেও আমাকে ডেকে নিয়েছিলেন, এই ব্যাপারে কী পদক্ষেপ সরকার নিচ্ছে, তা জানার জন্য। আমি বিভিন্ন সময় আপডেট জানিয়েছি।

“কয়েক দিন আগেও মাননীয় আইনমন্ত্রীর সাথে আলোচনা করেছি। উনাকে জানিয়েছি আদালতের উদ্বেগ। মাননীয় আইনমন্ত্রী আমাকে বলেছেন, ট্রাইব্যুনাল গঠনের জন্য অর্ডিন্যান্স জারি করে হলেও তা করা হবে। অতি শিগগিরই হয়ে যাবে।”

এক প্রশ্নে মাহবুবে আলম বলেন, “এখানে দুইটা মন্ত্রণালয়ের ব্যাপার আছে। আইন মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্যাপার এখানে। যেহেতু দুটি মন্ত্রণালয়কে একটি সমন্বিত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এখন পর্যন্ত সে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেহেতু সম্ভব হয়নি, তাই আদালত পরিস্থিতি অনুযায়ী একটা সমাধান দিয়েছেন।”